‘পানিচক্র’ নামটা পরিচিত মনে হতেও পারে, না-ও পারে। যদি পরিচিত মনে হয় তবে তা বেশ ভালো। ধারণা আরও ঝালাই করে নেওয়ার জন্যে এই লেখনের শেষ পর্যন্ত পড়ে যাওয়া মোটেও সময় নষ্ট হবে না।
আর যদি নাম পরিচিত মনে না হয়, কিংবা নাম চেনা হলেও আসলে এ বস্তুটি কী তা যদি ভুলে যান তবে লেখনটি আপনার জন্যই। তাহলে শুরুতেই জেনে নেই, পানিচক্র কী?
সংজ্ঞায়নে যাওয়ার আগে খুব সহজভাবে কিছু বিষয়ে ধরিয়ে দেওয়াটা প্রয়োজন মনে করছি। সহজভাবে ভাবুন, পানি নামক বস্তুটি মূলত কী। এর সূচনা স্থান কোথায়? অবশ্যই প্রকৃতি। কি তাইতো? তাহলে এবার ভাবুন-
যেহেতু বিষয়টি পানির সেহেতু এর বিচরণ ক্ষেত্রের পুরো জায়গাটাই প্রকৃতি। এতটুকু বুঝতে যদি অসুবিধা না হয় তাহলে মূল আলোচনায় চলে যাচ্ছি-
পানিচক্র হলো প্রাকৃতিক প্রভাবে বারবার রূপান্তর এর মাধ্যমে পানির চক্রাকারে অনবরত ফিরে আসা।
পানির এই চক্রাকার অবস্থাকে অনেক সময়ই হাইড্রোলজিক্যাল চক্র বলা হয়। যার সাংকেতিক রূপ H2O.
পানিচক্রের এই পুরো বিষয়টিই জড়িত মূলত শক্তি বিনিময়ের সাথে। যার ভূমিকা লক্ষণীয় তাপমাত্রা পরিবর্তনে। আচ্ছা বৃষ্টি দেখে কেমন লাগে আপনাদের? একেকজনের অনুভূতি কিন্তু একেকরকম। তবে বৃষ্টির পর চারপাশের যে হিমশীতল অবস্থা তা কিন্তু প্রকৃতিতে থাকা সব উপাদানের জন্যই এক। কখনও কি মনে এমন প্রশ্ন উঁকি দিয়েছে, কেন বৃষ্টি হলেই চারপাশ শীতল হয়ে যায়? মূলত বাষ্পীভূত পানিই চারপাশ শীতল করার জন্য দায়ী। আবার একইভাবে যখন প্রকৃতিতে জলীয়বাষ্পের ঘনত্ব বেড়ে যায় তখন এর প্রভাবস্বরূপ পরিবেশেও তাপমাত্রা বেড়ে যায়। আবার এই পানিচক্র সংঘটিত করার কাজটি করে সৌরশক্তি। এখন প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক যে, যেহেতু সৌরশক্তির কারণে পানিচক্র সংঘটিত হয় তাহলে তো পৃথিবী তো আরও উত্তপ্ত থাকার কথা। কি তাইতো?
পৃথিবীতে যত পানি রোজ বাষ্পীভূত হচ্ছে তার ৮৬% ই কিন্তু সমুদ্রের পানি। যে কারণে পৃথিবী শীতল থাকে। অতটা উত্তপ্ত হয়ে যায় না।
বেশ কঠিন কঠিন আলাপ হয়ে গেলো, তাই না? একটু সহজ হওয়া যাক তাহলে। আচ্ছা, বলুন তো! কখনও কি পানির এত উৎস কিংবা রূপ দেখে অবাক হয়েছেন? মনে প্রশ্ন এসেছে কখনও? মাটির নিচেও পানি, আবার পুকুর কিংবা খাল-বিলেও পানি, সমুদ্রে পানি, স্থলসীমানা ঘেষে পানির সীমানা শুরু হওয়া, বৃষ্টি, বরফ জমা, বাতাসে মিশে থাকা জলীয় বাষ্প কিংবা প্রচণ্ড তাপে পানির বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়া, আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে পানি পড়া, মেঘ রাজ্যে মেঘদের আনাগোনা বেড়ে চলা, বৃষ্টি বিন্দুগুলোর মাটিতে পড়ার প্রস্তুতি নেওয়া …. …. …… এ সবটা মিলিয়ে মনে কখনও প্রশ্নেরা উঁকি দেয়নি? বইয়ের ভাষায় এর সবটাকেই কিন্তু পানিচক্র বলে।
কি এবার সোজা লাগছে না?
প্রকৃতিতে পানির এই যে বিশাল ভাণ্ডার, দুই ভাগ জলের এই বিশাল পৃথিবীর শীতল অবস্থা বজায় রাখা, প্রচণ্ড তাপে পানি বাষ্প হয়ে প্রকৃতিতে মিশে যাওয়া, ছাদ হয়ে ঢেকে থাকা বিশাল আকাশের বুকে সাদা-কালো মেঘের সৃষ্টি, সেই মেঘ রাজ্য থেকে হন্যে হয়ে বৃষ্টি রূপে প্রকৃতির কাছে ফিরে আসা, এগুলো সবটা মিলিয়েই কিন্তু পানি। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন রূপে ধরা দিচ্ছে। আর এ সব মিলিয়েই পানিচক্র। এক কথায়, পানির যে চক্র তাই পানিচক্র। যা ইংরেজিতে Water Cycle নামে পরিচিত।
পানি যে বাষ্প হয়, সে কথা তো আপনারা জানেন? কীভাবে হয়, তাও কিন্তু জানা, তাই না? সূর্যের তাপে ভূপৃষ্ঠে থাকা পানি উত্তপ্ত অর্থাৎ গরম হয়ে ধীরে ধীরে বাষ্প হয় এবং মিশে যায় প্রকৃতিতে। আকাশ এবং বাতাস জুড়ে অসংখ্য জলের কণা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। পানি ফুটতে দেখেছেন না আপনারা? কিংবা ভাত রান্না? দেখেছেন একটা ধোয়ার মতো কিছু একটা উড়ে যায়? ওটাই বাষ্প। বাষ্প কিন্তু অনেক হালকা। তাই উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায় শত-কোটি জলকণা হয়ে। ঠিক যেন গ্যাসে ফোলানো বেলুন। ছেড়ে দিলেই আকাশে ঠুস করে উড়ে যায়!
এই যে সূর্যের কারণে পানির বাষ্প হয়ে উড়ে যাওয়ার কথা বললাম না? বিজ্ঞান এর নামকরণ কী করেছে জানেন? বাষ্পীভবন। ইংরেজিতে যাকে Evaporation বলা হয়। আর পানিচক্রের প্রথম ধাপই হলো এই বাষ্পীভবন।
কি, কঠিন লাগছে পানিচক্র? নামের তুলনায় ভেতরের বিষয়বস্তু সহজ না? শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
‘বাষ্পীভবন!’ কি শক্ত একটা নাম, তাও না? কি মনে হচ্ছে নাম জেনে? ভুলে যাবেন? তাহলে একটা মজার কাজ করুন। চুলায় আঁচ বাড়িয়ে পানি ভর্তি পাত্র দিন। এরপর তাকিয়ে দেখুন। সাদা সাদা ধোয়া বেরোচ্ছে? আসলেই এটা বাষ্প কী না, আসলেই তাপে পানি বাষ্প হয়ে উড়ে যায় কী না এটা বুঝতে হলে একটা কিছু দিয়ে পাত্র ঢেকে দিন অথবা কিছু একটা ধোয়ার উপর রাখুন। বিন্দু বিন্দু পানি দেখতে পান? বইয়ের ভাষায় এর নাম জলীয় কণা। আকাশে থাকা এই জলীয় কণাগুলোই নানান রকমের গ্যাস আর ধুলাবালির মিশ্রণে নাম পালটে হয় মেঘ। আর মেঘ সৃষ্টির এই প্রক্রিয়ার নাম ঘনীভবন। ইংরেজিতে যাকে Condensation বলা হয়। আর এই ঘনীভবনই হলো পানিচক্রের দ্বিতীয় ধাপ।
বাষ্পীভবনের মতো ঘনীভবন এর বিষয়টা নিয়ে কি একটু আগ্রহ লাগছে? বাসায় এটার পরীক্ষা করে দেখতে মন চাইছে? সম্ভব কিন্তু। ঐ যে চুলায় পানিভর্তি পানি দিয়েছিলেন, মনে আছে না? ধোয়া বের হলো, বাষ্পও হলো! এরপর ঢাকনা কিংবা ধোয়ার উপর কিছু ধরলে যে পানি জমে ওঠে সেই ঢাকনার গায়ে, খেয়াল করেছেন না? অর্থাৎ বাষ্প থেকে আবার পানি হওয়ার বিষয়টি বাসায় বসেই কিন্তু পরীক্ষা করা সম্ভব। তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়ালো? যদি জিজ্ঞাসা করি, মেঘের সৃষ্টি কীভাবে? উত্তর কিন্তু “পানি দিয়ে!” কি তাইতো? অর্থাৎ আপনি যদি মেঘ = পানি লিখেন, তাহলেও কিন্তু ভুল হবে না সমীকরণটা।
এবার আবার চুলা থেকে তৈরি সেই পানিতে ফিরে যাই। লক্ষ্য করে দেখবেন, বাষ্প থেকে পানি হয়ে উঠলে পানিগুলো ধীরে ধীরে ছোটো থেকে বড়ো হয়। এরপর ভারি হতে হতে নিচে গড়িয়ে পড়ে। একই কাজ আকাশেও হয়। আকাশে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানো মেঘগুলো পানির কারণে ভারি হয়ে এলেই সৃষ্টি হয় বজ্রপাতের। এরপর কী হয় জানেন? কখনও মেঘ, কখনও শিলা, কখনও বৃষ্টি, কখনও তুষার। পৃথিবীতে ফিরে এসে এরা জমতে থাকে সমুদ্রে, নদীতে, হাওরে, বিলে। অনেকটা আবার মাটি শুষে নেয়, প্রকৃতি শুষে নেয়, গাছ নিয়ে নেয়। অনেকটা গিয়ে জমা হয় মাটির একদম গভীরে। চমৎকার না বিষয়টা? এই যে মেঘ থেকে বৃষ্টি, তুষার, শিলা ইত্যাদি রূপে বিভিন্নভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসার এই প্রক্রিয়ারও একটা নাম আছে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে অধঃক্ষেপণ বলে। ইংরেজিতে যাকে Precipitation বলা হয়।
আর এই তিন বিষয় নিয়েই মূলত পানিচক্র। তার মানে পানিচক্রের মোট ধাপ ৩ টি-
১. বাষ্পীভবন বা Evaporation.
২. ঘনীভবন বা Condensation.
৩. অধঃক্ষেপণ বা Precipitation.
লিখেছেন-
লামিয়া তানজীন মাহমুদ