চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, মানুষ যাবতীয় ভারের বোঝা নিজেই বহন করছে, আবার মানুষের পিঠে চড়েই মানুষ বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও চাকা আবিষ্কার হওয়ার আগে ঠিক এমনটাই হতো। এরকম একটা সময় পার করার পর আস্তে আস্তে মানুষ বনের পশুকে গৃহপালিত প্রাণীতে পরিণত করে। গরু, গাধা, ঘোড়া, উট ইত্যাদি প্রাণীর পিঠে বোঝা চাপিয়ে মালামাল পরিবহন শুরু করে। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষ চাকা আবিষ্কার করে।
চাকা আবিষ্কারের আগের কথা
মানুষ কঠিন অনেক কিছু আবিষ্কার করে ফেললেও সবচেয়ে দরকারি জিনিসের আবিষ্কার করতে অনেকটা সময় নিয়ে ফেলেছে। তাই চাকার মতো সহজ একটি জিনিস আবিষ্কারের অনেক আগেই তারা সেলাই করার সুঁই, পালতোলা নৌকা কিংবা দড়ির মতো জটিল সব জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছিল। অথচ, নিজেকের চলাচল বা মালামাল পরিবহনের জন্য দীর্ঘকাল তারা বিভিন্ন প্রাণীর সাহায্যই নিয়ে চলেছে।
প্রাচীনকালে মানুষ জীবিকার তাগিদে বনে জঙ্গলে বেশির ভাগ সময় পার করত। একসময় গাছের গুঁড়ির চাকতি কেটে তার মাঝখানে ছিদ্র করে। সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম চাকা বলতে এটাকেই বুঝায়। এই চাকা আবিষ্কারের পর, এতে যুক্ত হলো একটি দণ্ড। দুই চাকাকে এক সাথে করে তার সঙ্গে যুক্ত হলো কাঠের পাটাতন। আর এভাবেই তৈরি হয়ে গেলো, মানব সভ্যতার প্রথম অপরিণত গাড়ি। এরপর প্রায় ২৮০০ বছর চাকা নিয়ে কেউ তেমন কোন কাজ করেননি।
১৮০৮ সালে উড়োজাহাজ আবিষ্কারের অন্তরালে জর্জ ক্যালি (১৭৭৩-১৮৫৭) একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। তিনি চাকার রিম আর চাকার অক্ষকে শক্ত তারের মাধ্যমে জুড়ে দেন। এতে করে চাকা ব্যবহারের জন্য আরও বেশি উপযোগী হয়ে উঠে। শুরুর দিকে এই চাকা দিয়ে শুধুমাত্র বাইসাইকেল চালানো যেত। মানুষ তখন এর ব্যবহার ঠিক মত না জানলেও বর্তমানে মোটর সাইকেল থেকে শুরু করে গাড়িতেও এই চাকা ব্যবহার করা হয়।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মধ্যেই ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে চাকার ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। এর পরের সহস্রাব্দে ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয়। আর খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দে চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায়। তখন থেকেই চীনে চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন শুরু হয়।
বিশেষজ্ঞের মতে, খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে তিন থেকে তিন হাজার বছর আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে (বর্তমানে ইরান) চাকা আবিষ্কৃত হয়। তখনকার বানানো সেই গাড়ির সাথে বর্তমানের গরুর গাড়ির কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এরপর ৩০০ বছর পরে, খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ অব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতেই প্রথম চাকা ব্যবহৃত হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি টানার কাজে।
এছাড়া ককেশাসের উত্তর দিকে কিছু কবর পাওয়া গিয়েছিল যেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০০ অব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে কবর দেওয়ার নমুনা পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও, দক্ষিণ পোল্যান্ডে একটি মাটির পাত্র পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে একটি চার চাকার গাড়ির ছবি দেখা যায়। সেখান থেকেই ধারণা করা হয়, মাটির পাত্রটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়ই নির্মিত হয়েছিল।
চাকা জীবনের গতি ফিরিয়েছে
আগের দিনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে কয়েক মাস লেগে যেত। দাদি-নানিদের থেকে এরকম গল্প আমরা কম বেশি সবাই শুনেছি। তাদের আগের প্রজন্ম কিভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমাত। এক মাসের জন্য হজে যেতেন কিন্তু হজে যেতে এক বছর কিংবা ছয় মাস লেগে যেত। অনেকে আবার এই যাত্রা পথ থেকে আর ফিরেও আসতেন না। মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থা যেমন কঠিন ছিল, ঠিক তেমনি মালামাল পরিবহনও অনেক কষ্ট সাধ্য ছিল। মাথায় নিয়ে, মানুষ কাঁধে করে বা কোন পশুর কাঁধে করে মালপত্র নিয়ে যেতে হতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়।
আগের দিনে এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেলে মাস না ঘুরলে আর কোনভাবেই খোঁজ পাওয়া যেত না কাছের মানুষের। এখন এক দেশ থেকে আরেক দেখে যাওয়া যেন মানুষের হাতের নাগালে। পাঁচ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বের সৌদি আরবে ছয় ঘণ্টায় চলে যাওয়া যায় বিমানে। বিমানের কথা ধরুন বাদ দিলাম, শহরের ভেতর কয়েকশ’ কিলোমিটার এখন কয়েক ঘণ্টায় চলে যাওয়া যায় সাইকেল, রিকশা, মোটরবাইক কিংবা গাড়িতে।
চাকা ও কর্মসংস্থান
চাকা-বিহীন পৃথিবীতে কর্মসংস্থানের সুযোগ ছিল খুবই কম। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক। বাস, ট্রাক, গাড়ি কোন যানবাহনই চালক ছাড়া চলে না। শুধু তাই নয়, যানবাহনে একজন চালকের প্রয়োজন ছাড়াও আরও অনেকের প্রয়োজন হয়। তাই অনেক পেশার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। এই মনে করুন, ট্রেন চালান একজন বা দুইজন।
কিন্তু ট্রেন ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত আছে বহু মানুষের জীবন ও জীবিকা। আবার মনে করুন, বাসের ড্রাইভার ছাড়াও থাকেন কন্ডাক্টর, হেলপার এমনকি টিকিট চেকার। তাই জীবন ও জীবিকার একটা বড় অংশে রয়েছে চাকার বিশাল অবদান।
পৃথিবীতে মানবসভ্যতাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে চাকার আবিষ্কার। জীবন এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ। রপেলার, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপ বা টারবাইন কিছুই আমাদের দেখা হতো না যদি চাকার আবিষ্কার হতো।