গণিতের মৌলিক চারটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা আলোচনা করছিলাম গুণ ও ভাগ নিয়ে। গত পর্বে আমরা গুণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছি। এই পর্বে আমরা ভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। পাশাপাশি গুণ ও ভাগের ব্যবহার, এদের মধ্যকার সম্পর্ক এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য গুণ ও ভাগ সম্পর্কিত সূত্রও জানার চেষ্টা করব।
ভাগ
গুণের ক্ষেত্রে আমরা বলেছিলাম- গুণ হলো যোগের সংক্ষিপ্ত রূপ। আর ভাগ হলো বিয়োগের সংক্ষিপ্ত রূপ। মূলত একটি ক্ষুদ্রতম সংখ্যা অপর একটি বৃহত্তম সংখ্যার মধ্যে কতবার আছে তা নির্ণয় করাকে ভাগ বলে।
৮ ভাগ ২ বললে আমাদেরকে বুঝতে হবে ৮ কে ২টি করে কতবার ভাগ করা যাবে। অন্যভাবে বললে বলতে পারব- ৮ কে ২, ২ … করে করে কতবার বিয়োগ করা যাবে। খেয়াল রাখতে হবে- ততক্ষণ বিয়োগ করতে হবে, যতক্ষণ না শূন্য হয় অথবা দুই থেকে ছোট ছোট বাকি থাকে।
ভাগের ইতিহাস
গুণের মতো ভাগের ক্ষেত্রেও অনেক গণিতবিদ অনেক সমাধান অনেকভাবে করলেও মূলত বহুল প্রচলিত ভাগ বা অবেলাস চিহ্ন (÷) প্রথমবার ব্যবহার করেন সুইস গণিতবিদ জোহান রান (Johann Rahn) ১৬৫৯ সালে তাঁর ‘Teutsche Algebra’ বইয়ে। এই গণিতবিদ শুধু ভাগ চিহ্ন না শুধু, সুতরাং (∴) চিহ্নেরও প্রবর্তক।
বহুল প্রচলিত চিহ্নটি ছাড়াও আরও দুটি চিহ্ন সারা দুনিয়ায় ব্যবহৃত হয়। যেমন- আমাদের কম্পিউটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত এই ভাগ ( / ) চিহ্নটি প্রথম ১৮৪৫ সালে ব্যবহার করেন ব্রিটিশ গণিতবিদ ডি মরগান (De Morgan)। আর গুণের মতো ভাগের বহুল প্রচলিত চিহ্নটিও জার্মান গণিতবিদ গটফ্রিড লাইবনিজের (Gottfried Leibniz) পছন্দ না হওয়ার তিনি প্রথম আমাদেরকে পরিচিত করান ভাগের জন্য ব্যবহৃত এই (:) চিহ্নটিকে। একে অনুপাতের জন্যও ব্যবহার করা হয়।
ভাগ করার নিয়ম
ভাগও আমরা কয়েকটি নিয়মে করতে পারব। আমরা আলোচনায় সাধারণ নিয়ম ও সংক্ষিপ্ত নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। এজন্য মাদের প্রথমে ভাগে ব্যবহৃত কয়েকটি পদ সম্পর্কে জানতে হবে।
ভাজ্য: যে সংখ্যাকে ভাগ করা হবে তা ভাজ্য।
ভাজক: যে সংখ্যা দ্বারা ভাগ করা হবে তা ভাজক।
ভাগফল: ভাগ করার কর প্রাপ্ত ফলাফল হলো ভাগফল।
ভাগশেষ: ভাগ করার পর ভাজ্য অবশিষ্ট থেকে গেলে, যা বাকি থাকবে, তা-ই ভাগশেষ।
এক অংকবিশিষ্ট সংখ্যার ভাগ আমরা সহজেই করতে পারলেও, বড় সংখ্যার ভাগ বিয়োগ করে করে করাটা কষ্টসাধ্য হওয়ায় ভাগের নিয়ম অনুসারে করে আমরা সহজে সমাধান করতে পারব। একটি চিত্রের মাধ্যমে বোঝা যাক-

- এখানে ভাজ্য ৬৯৭৩৮ ও ভাজক ২৪৫
- আমাদেরকে ভাজ্যের ডানপাশ থেকে বামপাশে ভাগ করে করে সমাধান করতে হবে
- ভাজক যেহেতু ২৪৫ এবং তিন অংকের, আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে ভাজকের তিন অংক নিয়ে কাজ করার।
- ভাজকের প্রথম তিন অংক নিয়ে গঠিত সংখ্যা ৬৯৭ যা ২৪৫ থেকে বড়। তাই আমাদেরকে ২৪৫ এর সাথে ১, ২, ৩… এভাবে গুণ করে করে ৬৯৭ এর সমান বা তার চেয়ে ছোট সংখ্যা আনতে হবে।
- ২৪৫ এর সাথে ২ গুণ করে ৪৯০ পাওয়া যায়। তাই ৪৯০-কে ভাজ্যের নিয়ে স্থানীয় মান অনুসারে বসানো হয়েছে এবং ভাগফল হিসেবে ২ বসানো হয়েছে।
- ৬৯৭ থেকে ৪৯০ বিয়োগ করে ২০৭ পাওয়া যায়। এই ২০৭ এখন নতুন ভাজ্য।
- ২০৭ হলো ২৪৫ থেকে ছোট। তাই, ভাজ্যের পরবর্তী অর্থাৎ চতুর্থ সংখ্যা ৩ নিচে নামানো হলো। নতুন সংখ্যাটি ২০৭৩।
- এখন ২০৭৩ ২৪৫ থেকে বড় হওয়ায় আগের মতো আবারও আমরা ২৪৫ এর সাথে ১, ২, ৩, … এভাবে গুণ করে ২০৭৩ এর সমান বা এর চেয়ে ছোট সংখ্যা খুঁজব। খেয়াল রাখতে হবে- অনেক সময় একটি সংখ্যা নিচে নামালেও ভাজক থেকে ছোট থাকে। তখন দুটি সংখ্যা নামাতে হয় একসাথে। একসাথে দুটি সংখ্যা নামালে ভাগফলে একটি শূন্য বসাতে হয়।
- ২৪৫-কে ৮ দ্বারা গুণ করলে ১৯৬০ পাওয়া যায়। তাই ভাগফলে ৮ এবং ভাজ্যের নিচে ১৯৬০ বসানো হয়েছে। ঠিক এগের মতো বিয়োগ করে ১১৩ পাওয়া গেলে, উপর থেকে শেষ সংখ্যা ৮ নামানো হয়।
- নতুন ভাজ্য ১১৩৮ হয়। এখন ২৪৫ কে ৪ দ্বারা গুণ করে ৯৮০ পাওয়া যায়।
- ভাগশেষ হিসেবে ১৫৮ থাকে।
মনে রাখতে হবে- ভাগশেষ সবসময় ভাজক থেকে ছোট হবে
গুণের মতো ভাগের ক্ষেত্রেও সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি রয়েছে যদি ভাজ্য ও ভাজক উভয়ের শেষে শূন্য থাকে। অর্থাৎ, ১১০০÷১১০ হলে, আমরা ডানপাশ থেকে শূন্য বাদ দিতে পারব ভাজ্য ও ভাজক থেকে। যেমন, ভাজকে একটি শূন্য থাকায়, একটি করে শূন্য বাদ দিলে থাকবে ১১০ ও ১১। এখন প্রাপ্ত লঘিষ্ঠ বা ছোট হওয়া সংখ্যা দুটি সাধারণ নিয়মে ভাগ করা যাবে।
গুণ ও ভাগ সম্পর্কিত সূত্রাবলী-
- গুণফল =গুণ্য × গুণক
- গুণক = গুণফল ÷ গুণ্য
- গুণ্য= গুণফল ÷ গুণক
নিঃশেষে বিভাজ্য না হলে
- ভাজ্য= ভাজক × ভাগফল + ভাগশেষ।
- ভাজ্য= (ভাজ্য— ভাগশেষ) ÷ ভাগফল।
- ভাগফল = (ভাজ্য — ভাগশেষ)÷ ভাজক।
- গুণ ও ভাগের সম্পর্ক
গুণ ও ভাগ মূলত একে অপরের বিপরীত। একটি যোগ করে, অপরটি করে বিয়োগ। একটি অনেক বাড়ায়, তো আরেকটি অনেক কমায়।
এদের মধ্যে সম্পর্কে নিয়ে বলা যেতে পারে নামতা দিয়ে। যেমন- ১৩ × ২ = ২৬। এখন আমরা এখান থেকে বুঝতে পারব যে, ২৬ যেহেতু ১৩ ও ২, এই দুইটি সংখ্যার গুণফল। তাই, ২৬ কে ভাগ করে ১৩ ও ২ উভয়ই পাওয়া যাবে। ২৬ কে ১৩ ভাগেও ভাগ করা যাবে। ২ ভাগেও ভাগ করা যাবে।
উপরের আলোচনাকে আরেকটু সহজ করে বলা যায় যে, দুটি সংখ্যার গুণফল এবং একটি সংখ্যা জানা থাকলে, অপর সংখ্যা সহজেই ভাগ করে বের করা যাবে। ঠিক একই ভাবে, দুটি সংখ্যার ভাগফল ও একটি সংখ্যা জানা থাকলে, অপর সংখ্যা বের করার জন্য সংখ্যা দুটিকে গুণ করে দিলেই হয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে?
আগের উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। ধরি, দুটি সংখ্যার গুণফল ২৬ ও একটি সংখ্যা ১৩, তাহলে অপর সংখ্যা কত? আমরা গুণফলকে ১৩ দ্বারা ভাগ করে দিলেই অপর সংখ্যা হিসেবে ২ পাব। আবার, আমাদেরকে যদি বলে, দুটি সংখ্যার ভাগফল ২ এবং একটি সংখ্যা ১৩, অপর সংখ্যা কত? আমরা ১৩ এর সাথে ২ গুণ করে অপর সংখ্যা ২৬ পেয়ে যাব।
এসব সমস্যাকে আমরা সমাধান আকারে সমান চিহ্ন দিয়ে করে থাকি সহজেই। যেমন- দুটি দুটি সংখ্যার গুণফল ২৬ ও একটি সংখ্যা ১৩, তাহলে অপর সংখ্যা কত?- আমরা লিখতে পারি যে,
১৩ × অপর সংখ্যা = ২৬
এখন আমরা মনে রাখব, সমান চিহ্নের একপাশ থেকে আরেক পাশে কোনো সংখ্যাকে নিয়ে গেলে তাদের চিহ্নের পরিবর্তন হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু গুণ ও ভাগ একে অপরের বিপরীত, তাই গুণ চিহ্ন হয়ে যাবে ভাগ এবং ভাগ চিহ্ন হতে যাবে গুণ। খেয়াল রাখতে হবে, গুণ ও ভাগের প্রক্রিয়ায় প্রথমে কোন চিহ্ন না থাকলে গুণ চিহ্ন ধরে নিতে হবে,
এখন আমরা অপর সংখ্যা বের করার জন্য ১৩-কে সমান চিহ্নের অপর পাশে নিয়ে যাব। ১৩ এর আগে কোনো চিহ্ন না থাকায় সেটি গুণ ধরতে হবে। তাই, সমান চিহ্নের বিপরীত পাশে গিয়ে ভাগ হয়ে যাবে। ২৬-কে ১৩ দ্বারা ভাগ করে আমরা ভাগফল হিসেবে ২ পাব।
আশা করি, গুণ ও ভাগ নিয়ে অনেক সংশয় আপনাদের দূর হয়েছে। এরপরও হাতে-কলমে গুণ ও ভাগ সম্পর্কিত অনেক অনেক সমস্যার সমাধান করতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল ঘুরে আসতে পারেন, যেখানে রয়েছে শ্রেণিভিত্তিক গুণ-ভাগ নিয়ে আলোচনা ও সকল সমস্যার গাণিতিক সমাধান।