ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র তাহসিনের আজ জন্মদিন। বাসা থেকে তার সহপাঠিদের খাওয়ানোর জন্য তার মা তাকে অনেক গুলো চকলেট ও পেয়ারা দিল। ক্লাসে গিয়ে তাহসিন দেখল, তার কাছে ৮০টি চকলেট, ৪৮টি পেয়ারা ও ৩২ পিস কেক রয়েছে। সে বুঝে উঠতে পারছিল না কীভাবে জিনিসগুলো কতজনের মধ্যে সমান ভাবে ভাগ করে দিতে পারবে সহজেই।
তার মাথায় এলো যে, গতকালই মাত্র সে তার শিক্ষক নোমান স্যার থেকে ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. করা শিখেছে এবং কীভাবে ও কোথায় প্রয়োগ করতে হয় তা-ও জেনেছে। তাই সে চিন্তা করল, এখন গ.সা.গু. করে বের করে ফেলবে যে সবার মধ্যে সে কীভাবে ভাগ করতে পারবে সমান ভাবে। গ.সা.গু. করে সে ১৬ পেল। এখন সে বুঝতে পারল যে, ১৬ জন শিক্ষার্থীর মাঝে সমানভাবে চকলেট, পেয়ারা ও কেক ভাগ করা যাবে।
এমন গুরুত্বপূর্ন ও অনেক বড় বড় হিসাব সহজে করার জন্য মূলত আমরা ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. এর নিয়ম অনুসরণ করি। গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই ল.সা.গু. ও গ.সা.গু.। তাই আমরা আজকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একটু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।
গ.সা.গু. কী- গ.সা.গু. মূলত গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এখানে তিনটি শব্দ রয়েছে। তিনটি শব্দকে একটু ভাঙা যাক। গরিষ্ঠ অর্থ বড় বা সর্বোচ্চ বলতে পারি। সাধারণ আর গুণনীয়ক ভিন্ন ভিন্ন শব্দ হলেও এখানে একটি শব্দের মতো আচরণ করবে। এই সাধারণ গুণনীয়ক বলতে আমরা বুঝব দুই বা ততোধিক সংখ্যার মধ্যে যে গুণনীয়কগুলো সবার মধ্যে বিদ্যমান আছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে গুণনীয়ক আবার কী?- কোনো একটি সংখ্যাকে যে সকল সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে ভাগ করা যায়, তারা প্রত্যেকে সেই সংখ্যাটির গুণনীয়ক। আর নিঃশেষে বলতে বোঝায় ভাগশেষ না থাকা। এখানে বলে রাখা ভালো যে, ১ ভিন্ন সকল সংখ্যার কমপক্ষে দুইটি গুণনীয়ক থাকবে- একটি সেই সংখ্যা নিজেই, অন্যটি হলো এক। অর্থাৎ এক প্রতিটি সংখ্যার গুণনীয়ক। যেমন- ৬ এর গুণনীয়ক ১, ২, ৩, ৬।
ল.সা.গু. কী- গ.সা.গু. এর মতোই ল.সা.গু. সংক্ষিপ্ত রূপ। এর পূর্ণরূপ লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক। লঘিষ্ঠ বলতে ছোট বা সর্বনিম্ন এবং গুণিতক বলতে আমরা একটি সংখ্যাকে বিভিন্ন সংখ্যা দ্বরা গুণ করার ফলে সে সংখ্যাগুলো পাওয়া যায়, তাদেরকে বুঝব। যেমন- ৫ এর গুণিতক হতে পারে ৫, ১০, ৫০, ১০০….অগণিত।
গুণনীয়ক নির্দিষ্ট কিন্তু গুণিতক অনির্দিষ্ট
ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. কী আমরা জানলাম। ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. বের করার নিয়ম নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। প্রথমে গ.সা.গু. নিয়ে আলোচনা করি-
দুইভাবে গ.সা.গু. নির্ণয় করার পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা জানার চেষ্টা করব।
১। মৌলিক গুণনীয়কের সাহায্যে।
২। ভাগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
মৌলিক গুণনীয়কের সাহাযে গ.সা.গু. নির্ণয়-
- মৌলিক গুণনীয়কগুলো বের করতে হবে প্রদত্ত সংখ্যাদ্বয়/ সংখ্যাগুলোর।
- সাধারণ গুণনীয়কগুলোর গুণফল বের করতে হবে।
সাধারণ মৌলিক গুণনীয়কগুলোর গুণফল হলো গ.সা.গু.
একটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরে নিই ১২ ও ৩০ দুটি সংখ্যা।
১২ এর মৌলিক গুণনীয়কগুলো ২, ২, ৩
৩০ এর মৌলিক গুণনীয়কগুলো ২, ৩, ৫
এ দুটি সংখ্যার সাধারণ (Common) মৌলিক গুণনীয়কগুলো হলো ২ ও ৩। সুতরাং গ.সা.গু. হবে ২ ও ৩ এর গুণফল অর্থাৎ ৬।
মৌলিক সংখ্যা বলতে সেই সংখ্যাগুলোকে বোঝায় যাদের ১ ও সেই সংখ্যা ব্যাতীত আর অন্য কোনো গুণনীয়ক নেই। যেমন- ২, ৩, ৫।
ভাগ প্রক্রিয়ায় গ.সা.গু. নির্ণয়-
- দু’টি সংখ্যার ক্ষেত্রে যদি বড় সংখ্যাটি ছোট সংখ্যা দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য হয়, তাহলে ছোট সংখ্যাটি হবে গ.সা.গু.। যেমন- ১২ ও ২৪ এর গ.সা.গু. হবে ১২।
- দুইয়ের অধিক সংখ্যার ক্ষেত্রে প্রথমে সবচেয়ে ছোট সংখ্যা দ্বারা তার চেয়ে বড় সংখ্যাকে ভাগ করতে হবে। যদি নিঃশেষ বিভাজ্য হয়, তবে সর্বশেষ ভাগশেষটি হবে ওই দুই সংখ্যার গ.সা.গু.। সর্বশেষ ভাগশেষ দিয়ে সবচেয়ে বড় সংখ্যাকে যদি নিঃশেষে ভাগ করা যায়, তবে সেই সংখ্যাটি-ই হবে গ.সা.গু.।
উপরের কথাগুলো উদাহরণের মাধ্যমে বুঝে নেয়া যাক। যেমন- ২৮, ৪৮ ও ৭২ এর মধ্যে প্রথমে ৪৮ কে ২৮ দ্বারা ভাগ করা হয়েছে। সর্বশেষ ভাগশেষ পাওয়া যায় ৪। তাহলে ৪ হলো ২৮ ও ৪৮ এর গ.সা.গু.। পরবর্তীতে ৪ দ্বারা যেহেতু ৭২ নিঃশেষে বিভাজ্য, তাই ৪ হবে তিনটি সংখ্যারই গ.সা.গু.।
দুই বা ততোধিক সংখ্যার মধ্যে যদি কোনো সাধারণ গুণনীয়ক পাওয়া না যায়, তবে গ.সা.গু. হবে ১। কারণ, ১ সকল সংখ্যার গুণনীয়ক।
এবার একটু ল.সা.গু. নিয়েও আলোচনা করা যাক। ল.সা.গু. ও আমরা দুটি নিয়মে শেখার চেষ্টা করব গ.সা.গু. এর মতো।
১। মৌলিক গুণনীয়কের সাহায্যে
২। ইউক্লিডীয় পদ্ধতিতে
মৌলিক গুণনীয়কের সাহায্যে ল.সা.গু. নির্ণয়-
- মৌলিক গুণনীয়কগুলো বের করা।
- সংখ্যাদ্বয়/ সংখ্যাগুলোর গুণনীয়কগুলোর সর্বোচ্চ সংখ্যাগুলো নিয়ে গুণফল বের করা।
- গুণফল-ই হবে ল.সা.গু.।
যেমন- ৪, ৬ ও ৮ তিনটি সংখ্যা।
৪ এর মৌলিক গুণনীয়কগুলো ২, ২
৬ এর মৌলিক গুণনীয়কগুলো ২, ৩
৮ এর মৌলিক গুণনীয়কগুলো ২, ২, ২
এখানে আমরা দেখতে পাই দুই সর্বোচ্চ ৩ বার রয়েছে গুণনীয়ক হিসেবে এবং ৩ সর্বোচ্চ একবারই রয়েছে। এখন এদেরকে গুণ করে দিলেই আমরা ল.সা.গু. পাব। অর্থাৎ, ল.সা.গু. হবে ২x২x২x৩ =২৪
কোনো গুণনীয়ক যদি শুধু সর্বোচ্চ একবার থাকে কোনো সংখ্যায়, তাকেও নিতে হবে। শুধু সাধারন গুণনীয়কের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সংখ্যক বার নিতে হবে।
ইউক্লিডীয় পদ্ধতিতে ল.সা.গু. নির্ণয়-
- সংখ্যাদ্বয়/ সংখ্যাগুলোকে একই সারিতে কমা ( , ) চিহ্ন দিয়ে আলাদা করে রেখে একটি রেখা ( ˪ ) টানতে হবে।
- দুইয়ের অধিক সংখ্যার ক্ষেত্রে অন্তত দুটি সংখ্যাকে মৌলিক গুণনীয়ক দ্বারা ভাগ করতে হবে এবং ভাগফলগুলোকে নিচে নিচে লিখতে হবে।
- যে সংখ্যাগুলো বিভাজ্য হবে না সেগুলো অপরিবর্তিত রাখতে হবে।
- নতুন সারি নিয়ে আবার আগের নিয়মে কাজ করতে হবে।
- সর্বশেষ যখন এমন একটি সারি পাওয়া যেখানে সংখ্যাগুলো পরস্পর সহমৌলিক হবে, তখন সংখ্যাগুলো ও ভাজকগুলোর গুণফল বের করতে হবে।
- গুণফল-ই হবে ল.সা.গু.।
উদাহরণের মাধ্যমে বুঝে নেয়া যাক- ১২, ১৮, ২০, ১০৫ চারটি সংখ্যা। প্রথমে সর্বনিম্ন মৌলিক সংখ্যা ২ দ্বারা ভাগ করা হয়েছে। ভাগফলগুলো সংখ্যাগুলোর নিচে নিচে বসানো হয়েছে। ১০৫ যেহেতু নিঃশেষে বিভাজ্য না, তাই অপরিবর্তিত থেকে পরের সারিতে বসে গেছে। এভাবে করে নতুন সারিগুলোতে কাজ করতে করতে সর্বশেষ সারিতে ১, ৩, ১, ৭ পাওয়া গেছে। ৩ ও ৭ পরস্পর সহমৌলিক। তাই, সর্বশেষ ভাজকগুলো ও নিচের সারির সহমৌলিক সংখ্যাগুলোর গুণফল বের করে ল.সা.গু. নির্ণয় করা হবে।
সুতরাং, ল.সা.গু. হবে- ২ x ২ x ৩ x ৫ x ৩ x ৭ = ১২৬০
দুই বা ততোধিক সংখ্যার মধ্যে ১ ভিন্ন অন্য কোনো সাধারণ গুণোনীয়ক না থাকলে, তাদেরকে পরস্পরের সহমৌলিক সংখ্যা বলে। যেমন- ৬ ও ৭।
আমরা তো ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. কী, কীভাবে বের করতে হয় মোটামুটি জেনে নিলাম ভালোভাবেই। আমরা কি জানি ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. এর মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে?- হ্যাঁ, রয়েছে।
দুইটি সংখ্যার গুণফল = সংখ্যাদ্বয়ের গ.সা.গু. X সংখ্যাদ্বয়ের ল.সা.গু.
পূর্ণ সংখ্যার পাশাপাশি আমরা অনুপাত বা ভগ্নাংশের ল.সা.গু. ও.গসা.গু. ও বের করতে পারব। শুধু আমাদের জানতে হবে দুটি সূত্র-
অনুপাতের বা ভগ্নাংশের গ.সা.গু. = লবগুলোর গ.সা.গু. / হরগুলোর ল.সা.গু.
অনুপাতের বা ভগ্নাংশের ল.সা.গু. = লবগুলোর ল.সা.গু. / হরগুলোর গ.সা.গু.
যেমন- ৪/৫, ৮/১৫, ২/৩ তিনটি ভগ্নাংশ। ভগ্নাংশগুলোর গ.সা.গু. বের করতে হলে আমাদেরকে এদের লবগুলোর (৪, ৮, ২) গ.সা.গু. বের করতে হবে যা হলো ২। পরবর্তীতে হরগুলোর (৫, ১৫, ৩) ল.সা.গু. বের করতে হবে যা হলো ১৫। সুতরাং ভগ্নাংশগুলোর গ.সা.গু. হবে ২/১৫।
একইভাবে উপরের ভগ্নাংশগুলোর ল.সা.গু. বের করতে চাইলে লবগুলোর (৪, ৮, ২) ল.সা.গু. বের করতে হবে যা হলো ৮ এবং হরগুলোর গ.সা.গু. বের করতে হবে যা হলো ১। সুতরাং, ভগ্নাংশগুলোর ল.সা.গু. হবে ৮/১ বা শুধু ৮।
বলা যায় আজ ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. সম্পর্কে অনেক কিছুই ইতোমধ্যে জেনেছি। আমরা লেখার শুরুতে একটা ছোট ঘটনার মাধ্যমে গ.সা.গু. এর প্রয়োগও দেখেছি। এমন আসলে কোথায় কোথায় ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. মূলত আমর ব্যবহার করব বা আমাদের কেন প্রয়োজন এই গ.সা.গু. ও ল.সা.গু.-
- পাটিগণিতের ভগ্নাংশের সমস্যা সহজেই সমাধানের জন্য আমরা ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. ব্যবহার করি।
- ব্যবহারিক সমস্যা সমাধানে বা বলতে পারি বণ্টন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে আমরা ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. ব্যবহার করি।
- পরিমাপ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময় ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. প্রয়োজন।
- দুটি সংখ্যার গুণফল নির্ণয় করার জন্য শুধু ল.সা.গু. ও গ.সা.গু. জানা থাকাই যথেষ্ট!!!