দিনের আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথে যদি চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে যেত তাহলে কেমন লাগতো? অবিশ্বাস্য মনে হলেও আগের দিনে এমন অন্ধকারেই রাত গুলো পার করতেন মানুষ। তাই বিদ্যুৎ আবিষ্কার মানুষের জীবন যাপনের মান অনেকটাই বদলে ফেলেছে। বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ ছাড়া বাড়ি-ঘর, অফিস আদালত কোন কিছুই কল্পনা করা যায় না। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের অনেক অজানা ইতিহাস রয়েছে যা আমরা অনেকেই জানি না।
বিদ্যুৎ আবিষ্কারের ধারণা
অনেকেই ধারনা করেন, সতেরশো কিংবা আঠারশ সাল থেকেই বিদ্যুৎ আবিষ্কারের চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু আসলে আরও অনেক আগে থেকেই বিদ্যুৎ আবিষ্কার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা গবেষণা হয়েছে। ধারনা করা হয়, ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের নানা গবেষণার ফল হিসেবে পাওয়া যায় বর্তমান কালের এই বিদ্যুৎ।
তবে, সতেরশো শতাব্দীতে বিদ্যুৎ নিয়ে নানা রকম গবেষণা করা হয়। এর ফল হিসেবে আমরা বিদ্যুৎ না পেলেও পজিটিভ-নেগেটিভ কারেন্ট, ইলেকট্রিক জেনারেটর, কন্ডাক্টর, ইন্সিলেটর ইত্যাদি বিস্ময়কর আবিষ্কার পেয়েছি। ১৯৩০ সালে আর্কেলজিকাল গবেষণার ফলে প্রাচীন সভ্যতার ব্যাটারির খোঁজ পাওয়া যায়। এসব ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে, প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যুৎ আবিষ্কারের নিয়ে মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন ছিল এবং বছরের পর বছর নানা গবেষণা করেই মানুষ বিদ্যুৎ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে।
বিদ্যুতের আবিষ্কারক
প্রথমবার কে বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিল এই প্রশ্ন নিয়ে সব সময় সবার মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কিভাবে এটি আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং এর আসল আবিষ্কারক কে তার কোন সঠিক জবাব অনেকের কাছেই নেই। যেহেতু বিদ্যুৎ একদিনে আবিষ্কার হয় নাই তাই কে আবিষ্কার করেছে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। যুগ যুগ ধরে নানা গবেষণা করার পর এটি আবিষ্কৃত হয়েছে।
১৮২০ থেকে ১৮৩০ এর দশকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনের তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। সেই প্রাথমিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করেই আজও তাকেই বিদ্যুতের আবিষ্কারক বলা হয়। চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্যে তামার পাতের ঘূর্ণনের মাধ্যমে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন হতো। প্রকৃতি থেকে স্বাভাবিক উপায়ে বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করা সম্ভব না। প্রথমে তাই সাধারণ শক্তিকে বিদ্যুৎশক্তিতে রূপান্তরিত করে নিতে হবে। বিদ্যুৎ শক্তি সঞ্চারণ, বিদ্যুৎ শক্তি বিতরণ এবং বিদ্যুৎ শক্তি সঞ্চয় হলো অন্যান্য ধাপগুলো ।
কিন্তু সেসময় বেশি সময়ের জন্য বিদ্যুৎ পাওয়া যেত না। শুধু অল্প সময়ের জন্য বিদ্যুতের ব্যবহার করা যেত। ১৮ শতকের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকান বিজ্ঞানী বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রথম বিদ্যুতের ওপর ব্যবহারিক গবেষণা শুরু করেন। এমনকি ১৮৪০ সালে আবিষ্কৃত টেলিগ্রাফও ব্যাটারির মাধ্যমে ব্যবহার হতো। এসবের মাঝেই ১৮৩১ সালে ফ্যারাডের একটি আবিষ্কারের সূত্র ধরেই ডায়নামো আবিষ্কার হয়। তবে বই পুস্তক থেকে শুরু করে সব জায়গায় বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিনকে বিদ্যুতের মূল আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হয়।
কিন্তু খুবই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৭৯০ সালের ১৭ই এপ্রিল তিনি মারা যান। শুধু তাই নয়, নির্মমভাবে তিনি তাঁর আবিষ্কৃত বিদ্যুৎ দ্বারাই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। টমাস আলভা এডিসন বা টমাস এডিসন বিদ্যুৎ আবিষ্কারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কৃত হয়। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই আধুনিক বিদ্যুতের যাত্রা শুরু হয়। এডিসনো ১৮৮২ সালে প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ১৬ শতকের প্রথম দিকেই বিদ্যুতের উপর গবেষণা শুরু কিন্তু বেশি সময় ধরে চলবে এরকম বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয় ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে।
কিন্তু টমাস আলভা এডিসন ডিসি কারেন্ট আবিষ্কার করলেও নিকোলা টেসলা এসি কারেন্ট আবিষ্কার করেন। বর্তমানে আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে এক্সরে পর্যন্ত আমরা যত প্রযুক্তি ব্যবহার করি সবকিছুতেই বিদ্যুতের অবদান রয়েছে। আর, কোন না কোনভাবে টেসলার অবদান রয়েছে। এমনকি আমরা এখন পানির নিচে বিদ্যুৎ চালিত নানা কিছু দেখে যে বিস্মিত হই, সেই জল বিদ্যুতের ধারণাও দিয়েছিলেন এই টেসলা।
বিদ্যুতের আবিষ্কারের পর থেকে অন্য যে কোন কিছু আবিষ্কার আমার কাছে অনেক সহজ এখন। আর সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার সকল সরঞ্জাম আমরা সহজেই হাতের কাছে পাই শুধুমাত্র বিদ্যুৎ আমাদের আবিষ্কার হয়েছিল অনেক আগেই। পৃথিবীর সব প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পেছনে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বিদ্যুতের অবদান। বিদ্যুৎ তাই এখনো পৃথিবীর সেরা আবিষ্কারগুলোর মধ্যে অন্যতম।
বিদ্যুৎ এর ব্যবহার
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এত দ্রুত বিকাশ লাভ করতে পারত না যদি বিদ্যুৎ এর অবদান না থাকত। দিক-নির্ণয়, নির্ভুল হিসাব ইত্যাদি নানা কাজের জন্য যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় সেগুলো কোন না কোনভাবে বিদ্যুৎ এর উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও, পাতাল রেল, বৈদ্যুতিক ট্রাম, ট্রেন চলাচলের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন। কম্পিউটার, মোবাইল ফোন বিদ্যুৎ ছাড়া চলে না। মহামূল্যবান বিদ্যুৎ নির্ভর যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’। বর্তমান সভ্যতায় শিল্প-কারখানার বিকাশ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বা কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিকায়নে বিদ্যুতের বিকল্প নেই। বর্তমানে বিদ্যুৎ এর নানাবিধ ব্যবহারের মাধ্যমেই বর্তমান সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে আরও উন্নতির দিকে।
মানব ইতিহাসে যত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হয়েছে তাঁর ভেতর বিদ্যুৎ আবিষ্কার এক কথা সেরা। বিদ্যুতের এই উদ্ভাবন ছাড়া আমরা আমাদের বর্তমান জীবন কল্পনা করতে পারি না। বিদ্যুৎ আবিষ্কার হয়েছিল বলেই মহাকাশ অভিযান থেকে শুরু করে মহাকাশ বিজয়ের সাফল্যে আমাদের কাছে এসেছে।