বিজ্ঞান ও গণিত শাস্ত্রের উন্নতির ইতিহাসে পাই (π) এর একটি আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। বিজ্ঞানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধান মূলত পাই আবিষ্কার হওয়ার পর করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও জ্যামিতির ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এই আর্টিকেলে আমরা পাই সম্পর্কিত সকল তথ্য জানবো এবং এটা কিভাবে নির্ণয় করা হয় ও কোন কোন কাজে ব্যবহৃত হয় সে সকল বিষয় সম্পর্কে জানব।
পাই এর ইতিহাস
বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের প্রচেষ্টা থেকেই মূলত পাই আবিষ্কারের পথ আবিষ্কার হয়। বৃত্তের ব্যাসার্ধের বর্গকে ৩ দ্বারা গুণ করে বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করত ব্যাবিলিয়নরা আর জানা যায় তারা পাই এর মান ৩.১২৫ পায়। সে সময়ের হিসাবে পাই এর এত কাছাকাছি মান পাওয়া অবাক করার মত।
আর্কিমিডিস পাইয়ের অনেক নিখুঁত একটি মান নির্ণয় করতে সক্ষম হন। মূলত আর্কিমিডিসের দেখানো পথ ধরে পাইয়ের মান নিখুঁত ভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। তখনকার সময়ে বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করাটা ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। কারণ এখন আমাদের কাছে জানা রয়েছে যে পাই এর মান কি হবে এবং সূত্রের সাহায্যে আমরা খুব সহজেই বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করতে পারি। কিন্তু সেই সময় তেমনটা ছিল না আর যেটা আবিষ্কার করার জন্যই মূলত আজ বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা এতটা সহজ। আর্কিমিডিস বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করার জন্য বৃত্তের ভিতর একটি বর্গ আঁকেন এবং বাহিরে আরেকটি বর্গ আকেন এবং তাদের পরিসীমা নির্ণয় করে পার্থক্য বের করার মাধ্যমে বৃত্তের পরিসীমা নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। তিনি এই পদ্ধতি অনুসরণ করে একপর্যায়ে 96 বাহু-বিশিষ্ট বহুভুজ দিয়ে পাই এর মানের সীমা কমিয়ে ৩.১৪১ থেকে ৩.১৪৩ এর মধ্যে এনে ফেলেছিলেন।
আর্কিমিডিসের দেখানো সেই পদ্ধতি অনুসরণ করে এরপরে আরো অনেক গণিতবিদ এবং বিজ্ঞানীরা অনেকগুলো বাহুবিশিষ্ট বহুভুজ দিয়ে একই পরীক্ষা করেন। তারাও কাছাকাছি ফলাফল পেতে থাকেন যা পাই এর মান সঠিকভাবে নির্ণয় করার ক্ষেত্রে অনেকটা সাহায্য করে।
১৭০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে মূলত পাই এর মান বুঝাতে গ্রিক অক্ষর ‘π’ ব্যবহার করা শুরু হয়। বৃত্তর জ্যামিতিতে পাইয়ের ব্যবহার প্রচলন করেছিলেন গণিতবিদ উইলিয়াম জোন্স। মূলত তাঁর হাত ধরেই π এর বহুল ব্যবহার শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে সর্বজন-স্বীকৃতি লাভ করে।
পাই কাকে বলে
পাই (π) হচ্ছে একটি গাণিতিক ধ্রুবক যার মান 3.14159 (প্রায়)। বৃত্তের পরিধি ও ব্যাসের অনুপাতকে π বলা হয়। কোন বৃত্তের ব্যাস ১ একক হলে এর পরিধি হয় পাই এর সমান। বৃত্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান বের করার জন্য π এর ব্যবহার সবথেকে বেশি হয়ে থাকে।
বৃত্তের পরিধি নির্ণয়ে π এর ব্যবহার
ব্যাস এবং পাইয়ের গুণফল হচ্ছে বৃত্তের পরিধির। পরিধি নির্ণয় করতে হলে বৃত্তের ব্যাসকে পাই দ্বারা গুণ করতে হবে। আমরা জানি, ব্যাস ব্যাসার্ধের দ্বিগুণ। সাধারণভাবে পরিধির সূত্রকে লেখা হয়ে থাকে 2πr যেখানে 2r দ্বারা ব্যাসকে বুঝানো হয়।
ধরুন একটি বৃত্তের ব্যাস ৫ একক দেয়া রয়েছে। এখন বৃত্তটির যদি পরিধি নির্ণয় করা হয় তবে তা দাঁড়াবে:
2π5 বা 10π বা 31.4159 (প্রায়)
এভাবে আমরা একটি বৃত্তের শুধুমাত্র ব্যাসার্ধ জেনে বৃত্তটির পরিধি নির্ণয় করতে পারবো পাই এর সাহায্যে।
বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ে π এর ব্যবহার
একটি বৃত্তের ব্যাসার্ধের ক্ষেত্রফল এর সঙ্গে পাই এর গুণফলকে বৃত্তের ক্ষেত্রফল বলা হয়। পাই এর মান ব্যবহার করে খুব সহজে বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা যায়। কিন্তু পূর্বে যখন পাই এর মান মানুষের জানা ছিলোনা তখন কিন্তু এই কাজটা করাটা অনেকটাই কঠিন ছিল। ক্ষেত্রফল সমান πr² যা দিয়ে যে কোন প্রমাণ বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা যায়।
কোন একটি বৃত্তের ব্যাসার্ধ যদি ৫ একক হয় তবে তার ক্ষেত্রফল হবে, π5² বা π25 বা 78.5398 (প্রায়)।
এ সূত্র ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই যে কোন বৃত্তের ক্ষেত্রফল নির্ণয় করতে পারি। যদি আমাদের এখানে পাই এর মান জানা না থাকতো তবে হয়তো আমরা এই সূত্র দিয়ে ক্ষেত্রফল নির্ণয় করার কথা ভাবতেও পারতাম না।
Pi Day বা পাই দিবস
মার্চ মাসের ১৪ তারিখে মূলত পাই দিবস (Pi Day) উদযাপন করা হয়। সারা পৃথিবী জুড়ে এই দিনটিকেই পাই দিবস হিসেবে গণ্য করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে আইনস্টাইন যে দিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটা এই দিন এবং এই একই দিনে স্টিফেন হকিং মারা গেছেন! যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এই দিনটিতে সবথেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় পাই বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলোতে। এথেকে বোঝা যায় পাই এর গুরুত্ব বিজ্ঞান ও গণিত প্রেমীদের মধ্যে কতটা বেশি।
১৪-ই মার্চকে পাই দিবস হিসেবে পালন করার মূল কারণ হচ্ছে এই দিনটি অংকে প্রকাশ করলে পাই এর মান পাওয়া যায় অর্থাৎ ৩/১৪ পাওয়া যায়। এ কারণে পৃথিবী জুড়ে এই দিনটিকে পাই ধ্রুবকের স্মরণে পাই দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে।
অনেক অঞ্চলের সংস্কৃতিতে এই দিনটির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক বড় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। অনর্গল পাই এর মান মুখস্ত বলা থেকে শুরু করে দীর্ঘতম পথ জুড়ে পাই এর মান লেখার মত অনেক কাজ এই দিনটিতে করা হয়ে থাকে। বলতে গেলে গণিত আনুরাগীদের কাছে এদিনটি বেশ আনন্দের।
পাই এর গুরুত্ব
বৃত্ত সম্পর্কিত সকল ধরনের হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্রে পাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। বৃত্তের ক্ষেত্রফল থেকে শুরু করে বৃত্তের পরিধি নির্ণয় সকল ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজন হয়। পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে পাই ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও বৃত্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন আকৃতির জিনিসের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে π ব্যবহার করা হয়। যেহেতু পাই জ্যামিতিক সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তাই বিভিন্ন স্থাপত্য শিল্প তৈরি করার ক্ষেত্রে যে হিসাব-নিকাশ করা হয় সেখানেও এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ভবনের সঠিক আকৃতি এবং স্থায়িত্ব নিশ্চিত করার জন্য এর গুরুত্ব অপরিসীম।
জ্যোতির্বিজ্ঞানে π এর ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন বস্তুর দূরত্ব নির্ণয় থেকে শুরু করে লক্ষ বস্তুর পরিধি এবং কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে পৃষ্ঠের দূরত্ব নির্ণয় করার জন্য এর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দূরবর্তী এবং সহজে যাওয়া যায় না এমন স্থানের বস্তুর আকার-আকৃতি নির্ধারণের জন্য এর ব্যবহার অনেক বেশি পরিমাণে করা হয়ে থাকে।
এর থেকে বোঝা যায় দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা সকল ক্ষেত্রে পাই এর ব্যবহার চোখে পড়ার মতন। এজন্যই সারা পৃথিবী জুড়ে গণিতবিদ ও বিভিন্ন ফিল্ডে কাজ করা বিজ্ঞানীদের কাছে এর গুরুত্ব অনেক বেশি।
এই ছিল পাই বিষয়ক আমাদের এই আর্টিকেলটি। এরকম আরো তথ্যবহুল লেখা পড়ার জন্য আমাদের ওয়েবসাইটকে অনুসরণ করুন ও ঘুরে দেখুন। শিক্ষামূলক সকল নতুন ভিডিও পেতে আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করে রাখুন আর 90 Degree Education এর সঙ্গে থাকুন।